By Tanima Hazra

রোজ রোজ কতো মন্দিরে তার পূজা, রোজ রোজ কত বন্দনাগানে স্তুতি,
পাষাণের মাঝে নারীটিকে বৃথা খোঁজা, যূপকাষ্ঠে দিয়ে প্রত্যহ আহুতি।।
রোজ রোজ কতো হাটে মাঠে ধর্ষিতা,
লাঙ্গলের ফলায় ফেলে রেখে যাওয়া সীতা,
জোড়হস্তে বলছে ধরিত্রীকে, দ্বিধা হও, দ্বিধা হও, দ্বিধা হও তুমি হে মাতা।
অর্ধেক ভাসান তাঁর, অর্ধেক বোধন
মেয়েটি মেয়েই হতে, চেয়েছে যখন,
রূপের রূপকথা ছেড়ে, কাঁধে নিয়ে দায়, সেই অদ্রিজা হাঁটে পথ, স্বমহিমায়।
তোমার আমার দেখা রোগা জিরজির কোনো মেয়ে, হাঁফধরা বুকে যার এখনো অনেক দম,
প্রতিবাদের দৃঢ়তায় সে নিমেষেই হতে পারে রণচণ্ডী, দেখিয়ে দেবে
কিছুতে নয় সে কম।
যাকে তুমি কন্যাভ্রূণরূপে জন্মের আগেই হত্যা করো,
পত্নীরূপে সংসারে তার যোগ্য সম্মানটুকুও দিতে চাও না, কন্যারূপে মাথা উঁচু করে পুত্রের সমান অধিকার নিয়ে দাঁড়াতে দাও না, বধুরূপে নিগ্রহ করে থাকো, কিংবা গৃহের পরিচারিকারূপে আরও একটু অধিক শ্রম করিয়ে নিয়ে তীব্র শ্লাঘা অনুভব করো,
তাঁরা ঐ মন্দিরে সাজিয়ে রাখা মাটির পুতুলটিরই তো ভিন্ন ভিন্ন রূপ। কেন তবে মাটির পুতুলটি নিয়ে তোমাদের এতো উৎসব?? যদি রক্তমাংসের নারীটিকেই তার নায্য নিজস্ব স্থানটুকুই না দিতে পারো?
নারীটি এবং নদীটি এবং মাটিটি আমার যেন সেই দশমহাবিদ্যা, দশমহাবিদ্যার দশটি রূপ হচ্ছে - কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী, কমলা। এঁদের সবাইকে বর্তমানের আঙ্গিকে কল্পনা করে দেখি এঁরাই যেন আমার আশেপাশের যত চেনাশোনা নারী-
তাই তাঁদের সবাইকে নবরূপে স্তব করে আমার নিবেদন
দশমহাবিদ্যা -
কালী -
জগৎ ধারণ করতে চেয়ে
এখন আমি কালী
পায়ের তলায় আটকে রাখি
মরণ চোরাবালি
আঁশবটিতে শান দিয়েছি
জিভেতে হুংকার
শরীর ছিঁড়ে মাংস খেয়ে
আর পাবে না পার
অনেক জনম নত ছিলাম
আজ তুলেছি মাথা
কব্জিতে আজ অসুরবিনাশ
মুন্ডমালায় গাঁথা
মা হতে চাই, বোন হতে চাই
আর হতে চাই কন্যা
বুকের মাঝে প্রিয়া হয়ে
হতে চাই অনন্যা
তবু যদি নষ্ট চোখে
আবার চেয়ে দেখিস
নিজের হাতেই তবে নিজের
ফাঁসির আদেশ লিখিস।।
তারা -
মহানীল সরস্বতী,
বিষবিদ্যাজাতা,
পরণে ব্যাঘ্রচর্ম, অগ্নিতে ঘর পাতা,
বিদ্যা বেচে পেটের ভাত,
শিবের বুকে পা,
জীবন ছিঁড়ে, জীবন মেখে
গরাস তুলে খা।।
ষোড়শী -
ললিতাম্বা স্থিরমতি ত্রিপুরসুন্দরী
বামাটির কামনায় সবে বলিহারি
আহা কী ব্যাদানখানি
আহা কী গড়ন
সিংহাসনে বসি কন্যে পদ্মে রাখে চরণ
হাতে নিলো ইক্ষুধনু মন স্পর্শ করে
পাশ অঙ্কুশ নিলো বন্ধনমুক্ত করে
পুষ্পবাণে কামেশ্বর পঞ্চেন্দ্রিয়ে মরে
লাজবতী সহস্র নাম কামব্রতচারী
জনন গ্রন্থিতে কন্যা
ধরেন ব্রহ্মাণ্ডলহরী।।
ভুবনেশ্বরী -
জগদ্ধাত্রী মহামায়া শাসিকা শক্তি,
একই অঙ্গে ধরে আছে পুরুষ ও প্রকৃতি,
রক্তাভা শরীরে তিন নয়নের ছটা,
পঞ্চমুখে ব্যাখ্যা করে সৃষ্টিজন্মকথা,
চারহাতে চারদিকে লালন ও পালন,
ত্রয়ম্বকে ত্রিবিধ রূপে, লীলাসম্পাদন,
ব্রহ্মা ধরে সৃষ্টিতত্ত্ব, সাথে সরস্বতী,
বিদ্যা ও জ্ঞানের আলোক প্রসারণে ব্রতী,
বিষ্ণু গড়ে ঐশ্বর্য, সঞ্চয় সহিতে কমলা
অনন্ত শয্যায় জন্ম শস্যেতে শ্যামলা
শিব ভাগে ধ্বংসতত্ত্ব সাথে নিয়ে কালী,
জাগে আর মরে রোজ নক্ষত্রমন্ডলী।।
ভৈরবী -
মূলাধারে তিন বীজ
ইচ্ছা জ্ঞান ক্রিয়া
তাহাকে সম্যক বুঝি ত্রিচেতন দিয়া
সক্রিয় সুপ্তি এবং গভীর নিদ্রায়
এ মানব জনরাশি নিজেদের খায়
বাহু থেকেও নেই বল
চোখ থেকেও নেই চোখ
চলমান শরীর বয়ে হাঁটাচলা সার
ভার বাড়ে পৃথিবীর কমে না তো ভার
উচ্চতর মার্গে উঠে সহস্রার পানে
কুন্ডলিনীচক্র জাগে ঈড়া পিঙ্গলায়
অধর্ম নাশিতে ধর্ম রক্তমাংস খায়।।
ছিন্নমস্তা -
নিজহস্তে কেটে মাথা
ছিন্নমস্তা হাসে,
ফিনকি দিয়ে রক্তধারা
হৃদয় চলকে আসে,
রক্তঝরা শূন্য হৃদয়
এক্কেবারে খাঁ খাঁ,
উল্টো চোখে হে সব্বোনাশ
পলক খুলে তাকা,
উল্টো করে দ্যাখ পৃথিবী,
উলটে দুঃখ সুখ,
স্কন্ধকাটা রক্তবানে উথলে ওঠে বুক।।
ধূমাবতী -
কুৎসিত অলক্ষ্মী বিধুরা লোলচর্মসার
বায়সের পৃষ্ঠে চড়ে শ্মশানে সংসার
মৃত্যু জপে,মৃত্যু মাপে, মৃত্যুই অন্তিম,
জরা, ব্যাধি, শোক সত্য,বাকি সব ভ্রম
নারীকে যদি দেখো রূপের ঊর্ধ্বে উঠে
তবেই মোক্ষলাভ দিব্য ভাগ্যে ঘটে
ক্ষুধা, তৃষ্ণা, মৃত্যু , ক্ষতই প্রকৃত বাস্তব
প্রপঞ্চসারাৎসারে অনিত্য বাদবাকি সব
বগলা -
বাকশক্তিসংযম ধারণ জিহ্বা নিয়ন্ত্রণ,
লোলজিহ্বা ছিঁড়ে করো অরীয়দমন,
বুদ্ধিনিয়ন্ত্রিত বাক্যে স্বকর্মসাধন,
অতিবাক্যে বুদ্ধিনাশ শত্রুবৃদ্ধিযোগ,
শোনো বেশি বলো কম কার্যসিদ্ধি হোক।।
মাতঙ্গী -
কৃষ্ণাসরস্বতী হে, চন্ডালিনী হেলা
দলিত, চলিত, গলিত প্রান্তিক রমণী
উচ্ছিষ্টভোগ্যা মেয়ে হাড়মাস কালি
অনাদর অবহেলা শ্রমদায়/ গালি
শুদ্ধ অশুদ্ধির ভেদাভেদ ছেঁটে
সবটুকু গ্লানি মেখে সোজা এলে হেঁটে
গায়েতে হাতির জোর শ্রম হাতিয়ার
যার কাঁধে এ পৃথিবীর সব দায়ভার
ডামরী, ভ্রামরী সাথে গায় শুকপাখী
আয় রে মা ভুলে জাত বুকে তুলে রাখি
কমলা -
একহাতে সৃষ্টি রাখো, ধ্বংস অন্য হাতে,
অমৃত ও গরল দাও দুই এক সাথে,
কে নেবে অমৃত আর কে নেবে গরল,
এ জীবন হরেক মোহের জন্মমৃত্যুস্থল।
একই সরোবরে থাকে পঙ্ক ও পঙ্কজ,
হে মন কারে ফেলো, কাকে নিয়ে মজো,
তিল তিল বেদনায় মুকুতার বৃদ্ধি,
জীবন ভাণ্ডার জুড়ে ঋদ্ধি ও সিদ্ধি,
দশধা জুড়িয়া নারী দশদিশা জুড়ে
অপূর্ব মাতৃকা যেন পৃথিবী
শরীরে।