By Bratati Ghatak
অদ্বিতীয়া
ব্রততী ঘটক
ভোরের কুয়াশা ভেজা সকালে বেরিয়ে পড়লাম আমি।
আমার চেনা পৃথিবীটা ঘুরে দেখতে।
আজকের সকালটা ভারি সুন্দর।
শিশির মাখানো সবুজ ধানক্ষেত, হিমেল হাওয়া,
মুখে এসে পড়া রোদ্দুর, মাটির স্নিগ্ধ সুগন্ধ।
এসব যেন আমাকে সুপ্রভাত জানাচ্ছে।
ডালিম ফুলের একটি কুড়ি যেন আমাকে দেখে মিষ্টি হাসলো।
যেতে যেতে হটাৎ একটা কান্নার আওয়াজ কানে এলো।
শীতের সকাল না হলে হয়তো কানেই আসতো না। দেখতে গেলাম ব্যাপারটা কি?
দেখলাম একটা কুঁড়েঘরের দাওয়ায় বসে কাঁদছে একটি মেয়ে।
দেখেই বোঝা যায় সদ্যবিবাহিতা।
নিচু হয়ে বসে জিজ্ঞেস করলাম –“কাঁদছো কেন?” কোনো উত্তর এলোনা।
আমি আরো দু তিনবার জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটি এখনো নিরুত্তর।
একটু পরেই এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলো,
এসে মেয়েটির চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে ঘরের ভিতরে নিয়ে চলে গেলো।
মেয়েটি এখনো নীরব, প্রতিবাদ টুকু করলোনা।
শুধু বাঁ হাতে করে চোখের জল মুছে নিলো, তাও লুকিয়ে সবার অন্তরালে।
কিন্তু ব্যাপারটা আমার চোখ এড়ালোনা।
মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল।
এগিয়ে চললাম, সামনে একটা বস্তি চোখে পড়লো।
এখানে আরেকটা দৃশ্য।
দেখলাম কয়েকটা বাচ্ছা শুয়ে আছে,
কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে গেছে, চিৎকার করে করে ওরা ক্লান্ত।
কিন্তু মাঝবয়সী একটি মেয়ে, খুব সম্ভবত ওদের মা,
কত চেষ্টা করে যাচ্ছে ওদের হাসানোর।
কোলে সেলাই করার সূচ ও কাঁথা।
হয়তো ওর স্বামী গেছলো ফুটপাতে ,কোনো কাজের আশায়
দিয়ে আর ফেরেনি, কিংবা ফিরবেও না।
মেয়েটিও হয়তো তিন বাড়ি কাজ সেরে এসে ক্লান্ত।
কিন্তু তবুও ওই যন্ত্রনাকে সুতীব্র ইচ্ছায় বিঁধে ও তৈরী করতে চাইছে স্বপ্নের নকশী কাঁথা।
সকালের খারাপ হওয়া মন টা ভালো হয়ে গেলো।
ভালো লাগলো এটা ভেবে -যে দারিদ্রের কাঁটা গাছে ,
দুরন্ত স্বপ্নের রাঙাফুল ফোটার স্বপ্ন এখনো দেখে মেয়েটি।
এতক্ষনে সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়েছে,
রোদ্দুর যেন অতিদীর্ঘ বল্লমের মতো ,মেঘের হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে,
নেমে আসছে আমার চেনা পৃথিবীতে।
বাড়ি ফিরে এসেছি আমি, জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছি আমি।
মনে পড়ছে সকালের দৃশ্য দুটো।
বিক্ষিপ্ত, কিন্তু কোথাও একটা অদ্ভুত মিল, মিল দুজনের নীরবতায়।
একটা মেয়ে বেঁচে থাকার জন্য, নীরবে অত্যাচার সহ্য করছে
আরেকজন বেঁচে থাকার জন্য,নীরবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
তবু এই নীরবতা কেন? শুধু নারীদের জন্যই কি?
যখন অনেক কিছু বলতে চেয়েছি ,তোমরা বলতে দাওনি।
তাই আজ স্তব্ধ হয়ে গেছে সব অনুভূতি।
তাই যখন টুকরো হয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো, ভবঘুরেরা কুড়িয়ে নিয়ে গেছে,
তখনো আমরা কিছু বলিনি।
যখন স্বামীর মৃত্যুতে, কেড়ে নিয়েছো লাল পেড়ে শাড়ি, সিঁথির সিঁদুর,
বিষন্নতার পোড়ো ঘরে, বিষাক্ত নিঃশ্বাসের মধ্যে একঘরে করে রেখেছো আমাদের,
তখন ও নীরবে সব কিছু মেনে নিয়েছি।
স্বয়ং দ্রৌপদী তো চরম লাঞ্ছনার পরেও বলেছিলেন –
“যা শুধু বিলাসের, সেই বস্ত্র কেড়ে নেয় যদি কোনো দুঃশাসন,
তো নিক, আমি কাঁদছি না।“
এই নীরবতার মাঝেও, তোমাদেরকে কি বলতে চেয়েছি জানো?
বলতে চেয়েছি, তুমি যুদ্ধে যাও, আমাকে সৈনিক পাবে।
যদি অস্ত্র চাও, তো পাঁজরের হাড় থেকে পুরোনো স্বপ্নের চটা পড়া রং,
ঝেড়ে সাফ করে দেবো।
যদি কোনো মাঠে জনসভা ডাকো, তাহলে হাজার ঝড়ে,
শীতের হিমেল হওয়াতেও, আশার লণ্ঠন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো।
প্রয়োজন হলে একাই।
কিন্তু এর বিনিময়ে যদি কিছু চেয়েছি তো একটু ভালোবাসা, একটু সম্মান,
আর স্বত্রন্ত মানুষ হিসেবে, বেঁচে থাকার স্বীকৃতি।
কিন্তু এই নীরবতাকে ,যদি আমাদের দুর্বলতা ভেবে, উপহাস করতে থাকো,
তাহলে ভুল করবে।
কারণ এই চরম নীরবতা , তুমুল কালবৈশাখীর পূর্বের নিস্তব্ধতা মাত্র।
এই নীরবতা একবার ভেঙে গেলে, তোমাদের সমস্ত দর্প এক নিমেষেই চূর্ণ হয়ে যাবে।
আমাদের নীরবতা ভাঙার সাথে সাথে, মুখোশ পরা
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মুখোশটা খুলে যাবে।
“ত্রাহি ত্রাহি” রবে ভোরে উঠবে সারা পৃথিবী।
পুরানের দুর্গতিনাশিনী দুর্গার মতো, সেজে উঠবো আমরা।
চারদিকে শাঁখ বাজবে, উলুধ্বনি তে ভরে উঠবে আকাশ বাতাস।
সিঁটিয়ে থাকবে তোমরা, মানে সমাজের তথাকথিত নায়কেরা।
করজোড়ে, দর্পচূর্ণ হয়ে, তোমরাই যখন ক্ষমাভিক্ষা চাইবে
তখন সমস্ত নীরবতা ভেঙে শুনবে আমাদের কণ্ঠধ্বনি।
যা সমস্ত পৃথিবীর উদ্দেশ্যে বলবে – “একমেবা জগতত্রা, দ্বিতীয়া কা সমাপরা।“
“এই জগতে, আমি ই এক এবং অদ্বিতীয়া, দ্বিতীয়া আর কেও নেই।“